ব্রোকলি (Brassica oleracea var iltalica)
বা সবুজ ফুলকপি বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন কপি গোত্রের সবজি। কিছু দিন আগেও ব্রোকলি
বাংলাদেশের লোকের কাছে অপরিচিত ও অপ্রচলিত সবজি ছিল। কিন্তু বর্তমানে এটা লাভজনক হিসেবে
দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এবং সবার কাছে সমাদৃত বটে আমাদের দেশে। ব্রোকলির উৎপত্তি
ইতালিতে। ব্রোকলিকে ইতালিয়ান ব্যোকলি বলা হয়। ইতালি ভাষায় Brocco শব্দ থেকে এর উৎপত্তি
হয়েছে। ইতালি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এটি সর্বাধিক জনপ্রিয়। ব্রোকলি দেখতে ফুলকপির মতই, তবে রংটা সবুজ। এর বর্ণ সবুজ বলে
অনেকেই এক সবুজ ফুল কপি বলে। চাইনিজ খাবারের ব্যবহৃত অন্যতম প্রধান উপকরণ এই সবজী।
বাংলাদেশের অধিকাংশ লোকের কাছে ব্রোকোলি এখনো তেমন পরিচিত নয়। চমৎকার এই সবজিটি
এখন বাংলাদেশেই চাষ হচ্ছে এবং এটি দেশের চাইনিজ রেস্টুরেন্ট গুলোর চাহিদা মিটিয়ে
এটি এখন দেশের বাইরেও রপ্তানি হচ্ছে। কারণ কপি গোত্রের অন্যান্য সবজির চেয়ে ব্রোকলি
অপেক্ষাকৃত বেশি পুষ্টি সমৃদ্ধ ও ক্যান্সার প্রতিরোধক। এতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ভিটামিন, সি এবং খনিজ পদার্থ
রয়েছে এবং এর গন্ধটাও আকর্ষণীয়। ব্রোকলি ফুলকপির মত অত বড় হয় না। নিয়মিত ব্রোকলি
খেলে তারুন্যতা বৃদ্ধি পায়।
ব্রোকলি’র উপকারিতা
ব্রোকলিতে ক্যান্সার প্রতিরোধক আছে। মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোনিয়া ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী সান্টা বারবার জানিয়েছেন, ব্রোকলিতে
আইসোথিয়োসায়ানেটস নামে বিশেষ ধরনের যৌগ রয়েছে যা ক্যান্সার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।
ব্রোকলি স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ যে ভূমিকা রাখে তা মোটামুটি আমাদের সবার জানা। ভিটামিন-এ
এর অভাবে আমাদের দেশের শিশুরা রাতকানা ও অন্ধত্ব রোগে ভোগে। ব্রোকলি এই ভিটামিন-এ এর
অভাব দূর করে শিশুদের রাতকানা ও অন্ধত্ব রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে। এছাড়াও রোগ প্রতিরোধ
ক্ষমতা বাড়ায় ও অস্থি বিকৃতি প্রভৃতির উপসর্গ দূর করে। ব্রোকলি অত্যন্ত সুস্বাদু উপাদেয়
ও পুষ্টিকর সবজি বটে। এর অগ্রীয় ও কক্ষীয় কুঁড়ি পরিণত বয়সে সবুজ বর্ণের পুষ্প মঞ্জুরিতে
রূপান্তরিত হয়। পুষ্প মঞ্জুরি ভাজি, স্যুপ ও তরকারি হিসেবে খাওয়া যায়। কপির চেয়ে লঘু
বিধায় ব্রোকলি কেবল সিদ্ধ করে বা টাটকা অবস্থায় খাওয়া যায়। ব্রোকলির কা-ও খাওয়া যায়।
এর কা- ফুলকপির চেয়ে নরম, পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। কোনো কোনো দেশে কা- দিয়ে কাসুন্দি তৈরি
হয়। একটি ফুলকপি একবারই সংগ্রহ করতে হয়। কিন্তু ব্রোকলি পর্যায়ক্রমে কয়েকবার সংগ্রহ
করা যায় বলে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। এর দামও ফুলকপির চেয়ে বেশি। বসতবাড়িতেও ফুলকপির
চেয়ে আনুপাতিক কম যত্নে ব্রোকলি উৎপাদিত হতে পারে। বাণিজ্যিকভাবে ব্রোকলি চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে
অনেক লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ সবজি রপ্তানিযোগ্য।
ব্রোকলি চাষে প্রয়োজনীয়
জলবায়ু ও মাটি
সাধারণভাবে
যে ধরনের জলবায়ুতে ফুলকপির চাষ হয় সেখানে ব্রোকলিও ভাল জন্মে। তবে ব্রোকলির পরিবেশিক
উপযোগিতার সীমা একটু বেশি বিস্তৃত৷ পানি জমে না এরূপ উঁচু জমি, উর্বর দোআঁশ মাটি
হলে ফলন ভালো পাওয়া যায়। ব্রোকলির গাছ ১৫-২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সবচেয়ে
ভাল জন্মে৷ ব্রোকলি এপ্রিল মাসের পরেও ভালো ফলন দিতে পারে। দেশের সব অঞ্চলেই ব্রোকলি
চাষ করা যেতে পারে। সেচ ও পানি নিষ্কাশনের সুবিধা আছে এমন জমি ব্রোকলি চাষের জন্য
নির্বাচন করতে হবে। ব্রোকলির সফল চাষের জন্য মাটিতে যথেষ্ট পরিমাণে জৈবসার থাকা
প্রয়োজন। মাটি উর্বর ও মাটির অম্ল-ক্ষারত্ব (PH) ৬.০-৭.০ হলে ভালো। বেলে দোআঁশ, দোআঁশ
ও এঁটেল মাটিতে ব্রোকলি চাষ ভালো হয়। তবে সেচ ও পানি নিষ্কাশনের সুবিধা আছে এমন জমি
ব্রোকলি চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে।
ব্রোকলি’র উল্লেখযোগ্য জাত
ব্রোকলি
শুধুমাত্র সবুজ রঙের হয় না। এর বিভিন্ন রঙের বিভিন্নতা আছে। বেগুন বা সাদা রঙের
ব্রোকলিও আছে। বেগুনি রঙ্গের জাত গুলো বেশি শক্ত এবং সবুজ রঙ্গের চেয়ে কম স্বাদের
হয়ে থাকে। সাধারণত আঁটসাঁটো মাথার ছোট আঁকারের গাড় সবুজ বা নীলাভ সবুজ রঙের
ব্রোকলি জাতের চাহিদা বেশি। উল্লেখযোগ্য জাতগুলো হচ্ছে- প্রিমিয়াম ক্রপ, গ্রিন
কমেট, ডিসিক্কো, টপার-৪৩, ডান্ডি, সপ্রডিটিং টেক্সাস ১০৭, গ্রিন ডিউক, ক্রুসেডার,
ওয়ালথাম ২৯, গ্রিন মাউন্টেইল, ইতালিয়ান গ্রিন, গ্রীন বাড ইত্যাদি। এর সবগুলো জাতই
বিদেশ থেকে আমদানি করা৷ বর্তমানে আমাদের দেশে জাপান থেকে বেশ কিছু জাতের ব্রোকলি
বীজ আসছে ও বাজারে বিক্রি হচ্ছে। বাংলাদেশের আবহাওয়া ব্রোকলির বীজ উৎপাদনের
উপযুক্ত নয় বলে প্রতি বছরই বীজ আমদানি করতে হয়।
বীজ বপনের সময়
ভাদ্র-আশ্বিন (মধ্য আগস্ট-মধ্য অক্টোবর) মাস
পর্যন্ত। কার্তিক (মধ্য-নভেম্বর) মাস পর্যন্ত বীজতলায় বীজ বোনা যায়। তবে সেপ্টেম্বরের
শেষে সপ্তাহ বীজ বপনের উপযুক্ত সময়।
চারা তৈরি
পাতা
পচা সার বা গোবর সার ১ ভাগ, বালু ১ ভাগ ও মাটি ২ ভাগ মিশিয়ে ব্রোকলির বীজতলা তৈরি
করতে হয়। অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত ব্রোকলির চারা রোপন করা
যায়। কম বয়সের চারা দ্রুত বাড়ে। সেপ্টেরম্বর মাসে যখন বৃষ্টি কমে আসে তখন উঁচু জমি
দেখে বীজতলা করা যায়। বীজতলায় ১ মিটার চওড়া করে বেড তৈরি করতে হবে। বেডের
মাটি ভাল করে কুপিয়ে ঘাস আগাছা পরিষ্কার করে প্রতি বর্গমিটারে ৪ থেকে ৫ কেজি গোবর
সার মাটির সাথে মিশিয়ে বেড সমান করে কয়েকদিন রেখে দিতে হবে। আগাম মৌসুমে বৃষ্টি
হলে বীজতলায় পলিথিনের ছাউনি দিয়ে বৃষ্টির সময় চারাকে রক্ষা করতে হবে। চারা রোপনের
সময় হিসাব করে চারা উৎপাদন করতে হবে। এক হেক্টর জমির চারার জন্য বীজতলায় ২৫০ থেকে ৪০০
গ্রাম বীজ বুনতে হবে। প্রতিটি বীজতলায় ১৫০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ১০০
গ্রাম এমওপি প্রয়োগ করতে হয়। চারা বৃদ্ধির হার কম হলে প্রতিটি বীজতলায় ৮০-১০০ গ্রাম
ইউরিয়া মাটিতে রসযুক্ত অবস্থায় প্রয়োগ করতে হয়। বীজতলায় বীজ দেয়ার সময় কিছু বেশি বীজ
ফেলতে হবে। প্রধান ক্ষেতে বা জমিতে চারা লাগানোর পর কিছু চারা মারাও যেতে পারে। মূল
ক্ষেতের চারা মারা গেলে যেন একই বয়সের এসব চারা দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করা যায়। মনে রাখবেন মাস খানেকের কম বয়সী চারা লাগানো ভাল। লক্ষ রাখতে
হবে কখনও যেন বীজতলা একেবারে শুকিয়ে না যায় আবার পানি জমে না থাকে। চারা তোলার
পূর্বে বীজতলায় সেচ দিয়ে নিতে হবে। তাহলে চারার গোঁড়া নরম হয়ে আসে এবং বীজ তুলতে
সহজ হয়।
উপযুক্ত জমি তৈরি ও চারা
রোপন
ব্রোকলি
ঠান্ডা আবহাওয়ার ফসল বলে বাংলাদেশে শুধু রবি মৌসুমে এর চাষ হয়। ব্রোকলির চাষ অবিকল
ফুলকপির মতোই। সারাদিন রোদ পায় এমন জমি ব্রোকলি চাষের জন্য নির্বাচন
করতে হবে। লাঙ্গল বা টিলার দিয়ে মাটি কয়েক দিন রোদে ফেলে রাখতে হবে। সেচ ও পানি নিষ্কাশনের
সুবিধার জন্য বেডে চারা রোপণ করাই ভালো। সেচ দেয়া এবং পানি নিষ্কাশনের জন্য নালা
অত্যন্ত জরুরি। চাষ দেয়ার সময় শতকে ২৫ থেকে ৪০ কেজি পচা গোবর বা খামারজাত সার
মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। মাটির সব ঘাস, শিকড় আগাছা, আবর্জনা, পরিষ্কার করে
ঢেলা ভেঙে ফেলে সমান করতে হবে। চারা লাগানোর পর চারার গোড়ায় অবশ্যই পানি দিতে হবে।
চারা রোপনের পূর্বে গোড়ার দিকে দু-একটি বড় পাতা কেটে বাদ দিলে চারা কম মরবে। চারার
মাথা থেকে নতুন পাতা ছাড়া শুরু হলেই বুঝতে হবে চারা মাটিতে লেগে গেছে এবং নতুন শিকড়
ছেড়ে মাটি থেকে খাবার ও পানি গ্রহণ শুরু করেছে।
চারার রোপন দূরত্ব
চারা থেকে চারা- ৫০ সেন্টিমিটার। সারি থেকে
সারি- ৬০ সেন্টিমিটার।
সার প্রয়োগ/ব্যবস্থাপনা
ব্রোকলির
জন্য অন্যান্য সার খুবই উপকারী। ইউরিয়া সারের পরিমাণ বাড়ানোর সাথে সাথে ফলনও বাড়ে।
জমি তৈরির সময় ও পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় পরিমান জৈব সার ও রায়াসানিক সার প্রয়োগ করতে
হবে। প্রতি হেক্টরে গোবর ১৫ হাজার কেজি, ইউরিয়া ২৫০ কেজি, এমপি ২০০ কেজি, টিএসপি
১৫০ কেজি এবং প্রতি চারায় পচা খৈল ৫০ গ্রাম হারে প্রয়োগ করতে হয়। জৈব সারের সাথে ইউরিয়া সার
চারা রোপণের ১৫ দিন পর থেক দুই কিস্থিতে সমান ভাগ করে দিতে হবে।
সেচ ও পানি নিষ্কাশন
সার
দেয়ার পরপরই সেচ দিতে হবে। জমি শুকনো দেখলে সেচ দিতে হবে।
আগাছা দমন
সার
দেয়ার ঠিক আগে আগাছা নিড়ানো ভালো। এতে সার ভালভাবে মাটির সাথে মিশতে পারে এবং
সারের অপচয় কম হয়। গাছের পাতা পরিপূর্ণভাবে ছড়ানোর পূর্ব পর্যন্ত জমি অবশ্যই
আগাছামুক্ত রাখতে হবে। তবে মনে রাখবেন ব্রোকলি একটি অগভীরমূলী ফসল। তাই গাছের গোড়ার
কাছাকাছি মাটি ৫ সেন্টিমিটারের বেশিগভীর করে নিড়ানো যাবে না। যদি বেড বা জমির মাটি
শক্ত হয়ে চটা বেঁধে যায় তবে অবশ্যই নিড়ানি বা কোদাল দিয়ে তা ভেঙে দিতে হবে।
পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন
ব্রোকলি
চাষের সময় জমিতে পোকার আক্রমণ হতে পারে। পোকা দমনের জন্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জৈব কীটনাশক
ব্যবহার করতে হবে। আমাদের দেশে ব্রোকলির সবচেয় ক্ষতিকর পোকা হল মাথাখেকো লেদা পোকা।
এছাড়াও আরও অন্যান্য পোকার মধ্যে রয়েছে ক্রসোডলমিয়া লেদা পোকা, বিছা পোকা, ঘোড়া
পোকা ইত্যাদি। এছাড়াও ব্রোকলির বিভিন্ন ধরণের রোগের মধ্যে আছে পাতায় দাগ ও কালো
পচা রোগ প্রধান সমস্যা। এছাড়া চারা ধ্বসা, গদাই মূল, মোজাইক, ইত্যাদি রোগ
দ্বারা আক্রমণ হয়ে থাকে।
ফসল সংগ্রহ
ব্রোকলি রোপণের ৬০-৭০ দিনের মধ্যে পুষ্পমঞ্জুরি
সংগ্রহের উপযুক্ত সময়। ধারালো ছুরি বা ব্লেড দ্বারা তিন ইঞ্চি কা-সহ পুষ্প মঞ্জুরি
কেটে সংগ্রহ করতে হয়। এভাবে একই জমি থেকে ১ মাসব্যাপী কয়েকবার ব্রোকলি সংগ্রহ করা যায়।
পুষ্প মঞ্জুরি মোটামুটি জমাট বাঁধা অবস্থায় সংগ্রহ করা উচিত।
ব্রোকলি’র ফলন
সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে হেক্টরপ্রতি ফলন ১২-১৩ টন পাওয়া যায়।
সাবাব ফারহান
বিসিএস (কৃষি)
কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার
ফুলবাড়ী, কুড়িগ্রাম।
উত্তর সমূহ